যদি লাল গোলাপ হঠাৎ কালো হয়ে যায়, যদি গাছের পাতা হয়ে যায় সাদা, শুভ্রতার সাদা রঙ যদি হয়ে যায় লাল, তাহলে কেমন লাগবে একটু ভাবুন তো? কি হবে ভালোবাসার গোলাপের, কি-ই বা হবে শুভ্রতার! বিশাল ঝামেলা। লাল গোলাপ হারাবে তার সকল আবেদন, গাছের পাতার বিমুগ্ধতা খুঁজতে গিয়ে বিফল হবে মানুষ। একটু বর্ণ বা রঙের পরিবর্তনের জন্য হয়ে যেতে পারে অনেক কিছু। সঠিক বস্তুর সঠিক রঙ হওয়া তাই বাঞ্চনীয়। আর এই রঙ দেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের চোখ এবং মস্তিষ্ক।
আমাদের মস্তিষ্কে রঙের অনুভূতি সৃষ্টি হয় কিভাবে? আমরা কি সব রঙ সম্পর্কে জানি?
রঙ পর্যবেক্ষণের কাজটা মানুষের চোখ এবং মস্তিষ্ক কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে করে থাকে। আমাদের চোখ এবং মস্তিস্ক একজোট হয়ে আলো-কে ট্রান্সলেট করে রঙে পরিণত করে। চোখের ভেতরে থাকা আলোক সংবেদী কোষ স্নায়ুর মাধ্যমে আমাদের মস্তিস্কে বার্তা প্রেরণ করে থাকে। অর্থাৎ এই আলোক সংবেদী কোষগুলো ডাকঘর এবং স্নায়ুগুলো ডাকপিয়নের মত কাজ করে। ডাকপিয়ন যেমন আমাদের কাছে চিঠি নিয়ে আসলে চিঠি পাবার পর আমাদের যেরকম আবেগের বিভিন্ন ধরণের অনুভূতি (হাসি,কান্না ইত্যাদি) সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনি আলোক সংবেদী স্নায়ু মস্তিস্কে বার্তা প্রেরণ করলে আমাদের মস্তিস্ক তখন আমাদের মাঝে রঙের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
আমাদের চোখের যে রেটিনা আছে, সেটা মিলিয়ন মিলিয়ন আলোক সংবেদী কোষ দ্বারা আবৃত। এর কিছু কোষ হচ্ছে রড কোষ, আবার কিছু কোষ হচ্ছে কোণ কোষ। এই আলোক সংবেদী স্নায়ুমুখগুলো আমাদের মস্তিস্কে স্নায়ু উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং অপটিক নার্ভের (দর্শন স্নায়ু) মাধ্যমে মস্তিষ্কের কর্টেক্সে পাঠায়। এভাবেই আসলে আমাদের মাঝে রঙের অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
কার মাথায় প্রথম রঙ নিয়ে গবেষণা করার কথাটা আসলো?
নিউটন সাহেবের মাথায় আপেল পড়ার পর থেকে উনি দুনিয়া দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কত কিছু আবিষ্কার করে।এই মহাকর্ষ আবিষ্কারের সাথেই তাঁর নাম সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত হয়। মজার ব্যাপার হল, আলো নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছেন এই নিউটন সাহেবই। তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিলেন যে, রঙ কোন বস্তুর নির্দিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্য নয়, এটা আলাদা কোনো বস্তুও নয়। এটা কি করে সম্ভব? তাহলে আমরা যে আপেলের রঙ লাল দেখি, তার রঙ কি লাল নয়?
আসলে, বস্তুর পৃষ্ঠ বা তলের উপরে আলো পড়লে যদি বস্তুটি আলোর সবটুকু শোষণ করে কোন একটা নির্দিষ্ট রঙ শোষণ করতে না পেরে সেই রঙটিকে প্রতিফলিত করে দেয়, তাহলে আমরা বস্তুটিকে সেই নির্দিষ্ট রঙের দেখি।
সেই হিসাবে বলা যায়, আপেলের মাঝে লাল রঙ নেই। আপেলের পৃষ্ঠে বা তলে যখন আলো আপতিত হয়, তখন আপেলের পৃষ্ঠটি লাল ব্যতীত অন্যান্য সকল রঙ শোষণ করে নেয়, এবং লাল রঙকে প্রতিফলিত করে। তাই আমরা আপেলকে লাল রঙের দেখি। আমরা আসলে এই প্রতিফলিত আলো দেখেই ভাবি যে আপেলটি লাল রঙের। তাঁর মানে দাড়ায়, আমরা আসলে প্রতিনিয়ত ধোঁকা খাচ্ছি। কেননা আপেল তো লাল রঙের নয়, আপেল শুধুমাত্র লাল রঙকে শোষণ করতে পারছেনা বলেই তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। আর আমরা তখন আপেলকে লাল রঙের দেখি।
রঙের ধরণ- রঙের কত বাহারঃ
রঙ মূলত দু’ধরণের – মৌলিক রঙ এবং যৌগিক রঙ।
মৌলিক রঙ বলতে আমরা সবাই বুঝি- লাল, সবুজ, নীল। কেউ কেউ মৌলিক রঙগুলোকে সংক্ষেপে “আসল” অর্থাৎ, আসমানী (নীল), সবুজ, লাল বলে থাকে।
তবে আপনি যদি চিত্রশিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, তখন মৌলিক রঙ হিসেবে লাল, হলুদ এবং নীলকেই পাবেন। সেক্ষেত্রে সবুজ একটি যৌগিক রঙ। তবে সাধারণত আমরা যে স্ট্যান্ডার্ডে রঙের বিচার করি, তাতে লাল, নীল, সবুজকে মৌলিক রঙ হিসেবে বলতে পারি।
আর এই লাল, নীল, সবুজ রঙকে সমান অনুপাতে মিশিয়ে আমরা সাদা রঙ পেতে পারি। আবার এই তিনটি রঙকে বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে আমরা আলোক বর্ণালীর সবক’টি রঙই পেতে পারি।
আর এই তিনটি মৌলিক রঙ থেকে আমরা যেসব রঙ পাব, এগুলো হচ্ছে যৌগিক রঙ।
এখন চলেন আরেকটু রঙ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি আমরা। আপনি কি জানেন, মোট রঙ কয়টি? আপনার রঙের পেন্সিল বক্স খুলে দেখলে হয়তো ৬টি, ১২টি অথবা ২৪টি রঙ দেখতে পাবেন। কিন্তু আসলেই মোট কয়টি রঙ আছে? উদাহরণ হিসেবে বলি, কোন বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলে সে লাল, নীল, কমলা, হলুদ ইত্যাদি আরও কয়েকটি রঙের নাম বলতে পারবে। আবার আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে হয়তো বেগুণী, ফিরোজা, বাদামী এই ধরণের আরও কয়েকটা রঙের নাম বলতে পারবেন। কিন্তু আমাদের চোখই প্রায় ১০ মিলিয়ন রঙকে পৃথকভাবে সনাক্ত করতে পারে। আমরা কেবল অল্প কিছু রঙের নামকরণ করেছি। এতসব রঙের নাম দেওয়া তো সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীরা প্রত্যেক রঙকে পৃথক করার জন্য তাদেরকে সংখ্যার এবং কোডের মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন। তাছাড়া রঙের আরও ভেরিয়েশনের জন্য কয়েকটি কালার মডেল প্রবর্তন করেছেন। কেননা, শুধুমাত্র লাল, সবুজ, নীল রঙ (RGB Color) দিয়ে একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জের বা সীমার র
যে কোষগুলো আমাদের রঙ দেখতে সাহায্য করেঃ
আলোক সংবেদী কোষ থেকে তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেত রেটিনার দ্বিতীয় একটি আন্তঃস্নায়ুজালিকা স্তরের মধ্য হয়ে গ্যাঙলিয়ন (একধরনের স্নায়ু) কোষ দিয়ে তৈরি তৃতীয় একটি স্তরে যায়। রেটিনার এই দুইস্তর একটি সুগ্রাহী ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রক্ষিপ্ত বিম্বে আলোকের তারতম্য পরিবর্তন (কনট্রাস্ট) বোঝার জন্য এই ক্ষেত্রটি সহায়তা করে। আলোক তারতম্য বলতে বোঝানো হচ্ছে ছবিতে থাকা বিভিন্ন বস্তুর কিনারার ধার কিংবা আলোছায়ার পরিবর্তনকে। আর গ্যাঙলিয়ন কোষের কাজ হলো এই তথ্যগুলোকে অন্যান্য তথ্যের সাথে সমন্বিত করে অপটিক স্নায়ুরজ্জুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করা।
অপটিক স্নায়ুরজ্জু এই তথ্যগুলো থ্যালামাসের মধ্য দিয়ে সেরেব্রাল কর্টেক্সে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেরেব্রাল কর্টেক্সেই মূলত দৃশ্য-প্রতীতির কাজ হয়। তবে অপটিক স্নায়ুরজ্জু দৃশ্য কর্টেক্স ছাড়াও মস্তিষ্কের আদিম অংশ, ব্রেনস্টেমের কাছেও কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করে। ব্রেনস্টেমের এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রিটেকটাম নামক একদলা কোষ। এদের কাজ হচ্ছে আলোক-তীব্রতা বুঝে চোখের পিউপিলের ছিদ্র বড়-ছোট করা। যখন বাহিরের আলো বেশ তীব্র, তখন ছোট ব্যাসার্ধের ছিদ্র আর যখন বাইরের আলো মৃদু, তখন বড় ব্যাসার্ধের ছিদ্র তৈরি করাই এর কাজ। ঠিক যেন ক্যামেরার এক্সপোজার নিয়ন্ত্রনের মতো। দেখার কাজে আরো কিছু কারিগরী বিষয় আছে। কোন তুলনামুলক স্থির চিত্র দেখার জন্য আমাদের চোখ আপনা-আপনি দ্রুত নড়াচড়া করে পুরো দৃশ্যপটটি চষে যায়। সাথে সাথে এই ছবিগুলোকে জোড়া লাগিয়ে একটি মাত্র সমন্বিত ছবি তৈরি করে মস্তিষ্কে। এই কাজটা অনেকটা প্যানারোমিক ফটোগ্রাফীর অনেকগুলো ছবি জোড়া দেয়া বা স্টিচিঙের মতো। তবে একটা পার্থক্য হলো প্যানারোমিক ফটোগ্রাফীর সময় লক্ষ্য থাকে দুই চোখে চারপাশের যতটুকু কৌনিক দূরত্বের ছবি আমরা দেখি তার চাইতে বিস্তৃত কৌনিক দূরত্বের ছবি তৈরি। বিপরীতক্রমে চোখের এই দ্রুত নড়াচড়ার মাধ্যমে ছবি জোড় দেয়ার কাজের লক্ষ্য ভিন্ন। একটা দৃশ্যর মধ্য দিয়ে একপাশ থেকে অন্য দিকে তাকানোর সময় যে মসৃণ ছবি তৈরি সম্ভব হয় এই দ্রুত নড়াচাড়ার কারণে। একে বলা হয় চোখের সাক্কাড (Saccade)। চোখের সাক্কাডিয় নড়াচড়া না থাকলে আমাদের দৃশ্যপট ঘোলা হয়ে যেতো। কেউ যখন কোন ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে তাকাচ্ছে, তখন তার চোখের দিকে খেয়াল করলে আপনি এই সাক্কাডীয় নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
No comments :
Post a Comment