Page

Choose Your Language

Saturday, July 2, 2016

উচুঁ বাড়ী-সুকুমার রায়।

উচূঁ বাড়ী
সুকুমার রায়


উঁচু বাড়ি

লোকে বলে—'মনুমেন্টের মতো উঁচু!' সেরকম উঁচু বাড়ি দেখলে আমরা বলি 'ইস্‌! বড্ড উঁচু বাড়ি।' কিন্তু একটিবার আমেরিকায় ঘুরে এস, তারপরে সেই বাড়িই তোমার চোখে নিতান্তই ছোট ঠেকবে। মনুমেন্টের মাথায় অমন আরও দু-চারটা মনুমেন্ট চাপাও, তবে আমেরিকার লোকে বলবে 'হ্যাঁ, কতকটা উঁচু বটে!' নিউ ইয়র্কের একটি বাড়ি পঞ্চান্ন তলা—সাড়ে সাতশ ফুট উঁচু! একটা সাধারণ তিনতলা বাড়ি প্রায় ৪০ ফুট উঁচু—এইরকম উনিশটা বাড়ি একটার মাথায় আরেকটা চাপালে তবে ৭৫০ ফুট উঁচু হয়! আমেরিকার এক একটা সহরে বিশতলা ত্রিশতলা চল্লিশতলা বাড়ির ছড়াছড়ি!—ভাবতে গেলে আমাদের মাথা ঘুলিয়ে যায়।

এক একটি বাড়ি যেন এক একটি সহর। তার মধ্যে কত অফিস কত দোকান কত হোটেল গির্জা ইস্কুল থিয়েটার বায়স্কোপ ডাকঘর সভাসমিতি! বাড়ির এক-এক জায়গায় সারি সারি খাঁচার মতো ঘর— তাতে চড়ে লোকে উঠছে নামছে, বিশ পঁচিশ তলা সিঁড়ি ভেঙে কষ্ট করে উঠতে হয় না। বাড়ির মধ্যে ত্রিশ হাজার লোক—সকলেই ব্যস্ত, চারিদিকে ছুটাছুটি অথচ কোন গোলমাল নেই। বন্দোবস্ত এমন সুন্দর যে কিছু একটা দরকার হলে তার জন্যে হাঁ করে বসে থাকতে হয় না বা বিশ মাইল দূরে ছুটতে হয় না। বাড়িতেই সবরকম দোকান—ঘরে বসে টেলিফোন কর, যা চাও দু মিনিটের মধ্যে ঘরে এসে হাজির!

বাড়িতে ঢুকলে দেখবে শুধু যে মাথার উপরে এতখানি দালান তা নয়—মাটির নিচেও দশ বিশ তলা। সেখানে সূর্যের আলো যাবার উপায় নেই—সারাদিন আলো জ্বেলে কাজ চলে। ওইসব নিচের তলাগুলোতে নানারকম কলকারখানা—ইলেকট্রিক কোম্পানির বড় বড় চাকাওয়ালা কল, বাড়ি গরম রাখবার জন্য বড় বড় 'বয়লার'—বড় বড় ছাপাখানা তাতে সকাল সন্ধ্যা খবরের কাগজ ছাপা হয়। কোন কোন রাস্তার দুধারে এইরকম দশ বিশ তলা বাড়ির সার চলেছে—তার ছায়ায় রাস্তা যেন অন্ধকার—সেখানে সূর্যের মুখ দেখা যায় না—আকাশ দেখতে হলে ঘাড় বাঁকিয়ে উপরে তাকাতে হয়। কিন্তু যারা একেবারে উপরে ত্রিশ বা চল্লিশতলায় থাকে তাদের আলো বাতাসের কোন অভাব হয় না। রাস্তার ধূলা সহরের কুয়াশা অত উঁচুতে পৌঁছয় না—কাজেই সেখানকার হাওয়া অতি পরিষ্কার।

বাড়িগুলো দেখতে যেমন আশ্চর্য, এগুলি তৈরি করার কায়দাও তেমনি অদ্ভুত। বাড়ি তুলবার আগে প্রায় ১০০/১৫০ হাত গর্ত কেটে ভিৎ খুঁড়তে হয়। যেখানে বাড়ি হবে, তার চারদিকে খুব মজবুত আর খুব উঁচু 'কপিকল' বসায়। সেই কলে বড় বড় লোহার থাম চাপিয়ে থামগুলাকে হিসাবমত ঠিক ঠিক জায়গায় বসান হয়। তারপর থামের গায় লোহার কড়ি বরগা বসিয়ে সেগুলোকে পেরেক স্ক্রু দিয়ে এঁটে দেয়। এমনি করে সমস্ত বাড়িটার একটা কঙ্কাল আগে খাড়া করা হয়। তারপর ঢালাই করা পাথুরে মাটির দেওয়াল দিয়ে কঙ্কালটিকে ভরাট করে তাতে দরজা জানালা বসালে পর তখন সেটা বাড়ির মতো দেখতে হয়। যারা এইসকল কাজ করে তাদের যে অনেকখানি সাহস দরকার তা বুঝতেই পার। মাটি থেকে ৪০০ হাত উপরে লোহার বরগার উপর দিয়ে হাঁটাহাটি করা—তার উপরে বসে কাজ কর্ম করা, কখন বা উপর নিচ ওঠা নামা—এসব যেমন তেমন লোকের কাজ নয়।

Read more ...

উকিলের বুদ্ধি-সুকুমার রায়।

উকিলের বুদ্ধি
সুকুমার রায়


উকিলের বুদ্ধি

গরিব চাষা, তার নামে মহাজন নালিশ করেছে। বেচারা কবে তার কাছে পঁচিশ টাকা নিয়েছিল, সুদে-আসলে তাই এখন পাঁচশো টাকায় দাঁড়িয়েছে। চাষা অনেক কষ্টে একশো টাকা যোগাড় করেছে; কিন্তু মহাজন বলছে, "পাঁচশো টাকার এক পয়সাও কম নয়; দিতে না পার তো জেলে যাও।" সুতরাং চাষার আর রক্ষা নাই।

এমন সময় শামলা মাথায় চশমা চোখে তোখোড়-বুদ্ধি উকিল এসে বলল, "ঐ একশো টাকা আমায় দিলে, তোমার বাঁচবার উপায় করতে পারি।" চাষা তার হাতে ধরল, পায়ে ধরল, বলল, "আমায় বাঁচিয়ে দিন।" উকিল বলল, "তবে শোন, আমার ফন্দি বলি। যখন আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াবে, তখন বাপু হে কথা-টথা কয়ো না। যে যা খুসি বলুক, গাল দিক আর প্রশ্ন করুক, তুমি তার জাবাবটি দেবে না— খালি পাঁঠার মতো 'ব্যা—' করবে। তা যদি করতে পার, তা হ'লে আমি তোমায় খালাস করিয়ে দেব।" চাষা বলল, "আপনি কর্তা যা বলেন, তাতেই আমই রাজী।"

আদালতে মহাজনের মস্ত উকিল, চাষাকে এক ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "তুমি সাত বছর আগে পঁচিশ টাকা কর্জ নিয়েছিলে?" চাষা তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, "ব্যা—"। উকিল বলল, "খবরদার!— বল, নিয়েছিলি কি না।" চাষা বলল, "ব্যা—"। উকিল বলল, "হুজুর! আসামীর বেয়াদবি দেখুন।" হাকিম রেগে বললেন, "ফের যদি অমনি করিস, তোকে আমই ফাটক দেব।" চাষা অত্যন্ত ভয়ে পেয়ে কাঁদ কাঁদ হ'য়ে বলল, "ব্যা— ব্যা—"। হাকিম বললেন, "লোকটা কি পাগল নাকি?"

তখন চাষার উকিল উঠে বলল, "হুজুর, ও কি আজকের পাগল— ও বহুকালের পাগল, জন্মে অবধি পাগল। ওর কি কোনো বুদ্ধি আছে, না কাণ্ডজ্ঞান আছে? ও আবার কর্জ নেবে কি! ও কি কখনও খত লিখতে পারে নাকই? আর পাগলের খত লিখলেই বা কি? দেখুন দেখই, এই হতভাগা মহাজনটার কাণ্ড দেখুন তো! ইচ্ছে ক'রে জেনে শুনে পাগলটাকে ঠকিয়ে নেবার মতলব করেছে। আরে, ওর কি মাথার ঠিক আছে? এরা বলেছে, 'এইখানে একটা আঙ্গুলের টিপ দে'— পাগল কি জানে, সে অমনি টিপ দিয়েছে। এই তো ব্যাপার!"

দুই উকিলে ঝগড়া বেধে গেল। হাকিম খানিক শুনে-টুনে বললেন, "মোকদ্দমা ডিস্‌মিস্‌।" মহাজনের তো চক্ষুস্থির। সে আদালতের বাইরে এসে চাষাকে বলল, "আচ্ছা, না হয় তোর চারশো টাকা ছেড়েই দিলাম — ঐ একশো টাকাই দে।" চাষা বলল, "ব্যা—!" মহাজন যতই বলে, যতই বোঝায়, চাষা তার পাঁঠার বুলি কিছুতেই ছাড়ে না। মহাজন রেগে-মেগে ব'লে গেল, "দেখে নেব, আমার টাকা তুই কেমন ক'রে হজম করিস।"

চাষা তার পোঁটলা নিয়ে গ্রামে ফিরতে চলেছে, এমন সময় তার উকিল এসে ধরল, "যাচ্ছ কোথায় বাপু? আমার পাওনাটা আগে চুকিয়ে যাও। একশো টাকায় রফা হয়েছিল, এখন মোকদ্দমা তো জিতিয়ে দিলাম।" চাষা অবাক হ'য়ে তার মুখের দিলে তাকিয়ে বলল, "ব্যা—।" উকিল বলল, "বাপু হে, ও-সব চালাকি খাটবে না— টাকাটি এখন বের কর।" চাষা বোকার মতো মুখ ক'রে আবার বলল, "ব্যা—।" উকিল তাকে নরম গরম অনেক কথাই শোনাল, কিন্তু চাষার মুখে কেবলই ঐ এক জবাব! তখন উকিল বলল, "হতভাগা গোমুখ্যু পাড়াগেঁয়ে ভূত—তোর পেটে অ্যাতো শয়তানি কে জানে! আগে যদি জানতাম তা হ'লে পোঁটলাসুদ্ধ টাকাগুলো আটকে রাখতাম।"

বুদ্ধিমান উকিলের আর দক্ষিণা পাওয়া হল না।

Read more ...

ভাবুক সভা-সুকুমার রায়।

ভাবুক সভা
সুকুমার রায়


ভাবুক সভা

পাত্রগণ

ভাবুক দাদা
 দ্বিতীয় ভাবুক
প্রথম ভাবুক
 ভাবুক দল

[ ভাবুকদাদা নিদ্রাবিষ্ট - ছোকরা ভাবুকদলের প্রবেশ ]
প্রথম ভাবুক ।
 ইকি ভাই লম্বকেশ, দেখছ নাকি ব্যাপারটা?
ভাবুকদাদা মূর্ছাগত, মাথায় গুজে র‍্যাপারটা!
দ্বিতীয় ভাবুক ।
 তাই তো বটে! আমি বলি এত কি হয় সহ্য?
সকাল বিকাল এমন ধারা ভাবের আতিশয্য!
প্রথম ভাবুক ।
 অবাক কল্‌লে! ঠিক যেমন শাস্ত্রে আছে উক্ত—
ভাবের ঝোঁকে একেবারে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত।
সাংঘাতিক এ ভাবের খেলা বুঝতে নারে মূর্খ—
ভাবরাজ্যের তত্ত্ব রে ভাই সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম!
দ্বিতীয় ভাবুক ।
 ভাবটা যখন গাঢ় হয়- বলে গেছেন ভক্ত,
হৃদয়টাকে এঁটে ধরে আঠার মতো শক্ত।
প্রথম ভাবুক ।
 (যখন) ভাবের বেগে জোয়ার লেগে বন্যা আসে তেড়ে,
আত্মারূপী সূক্ষ্ম শরীর পালায় দেহ ছেড়ে—
(কিন্তু হেথায় যেমন গতিক দেখছি শঙ্কা হচ্ছে খুবই
আত্মা পুরুষ গেছেন হয়তো ভাবের স্রোতে ডুবি।
যেমন ধারা পড়ছে দেখ গুরু-গুরু নিঃশ্বাস,
বেশিক্ষণ বাঁচবে এমন কোরো নাকো বিশ্বাস।
কোনখানে হায় ছিঁড়ে গেছে সূক্ষ্ম কোনো স্নায়ু
ক্ষণজন্মা পুরুষ কিনা, তাইতে অল্প আয়ু।
[ বিলাপ সঙ্গীত ]

ভবনদী পার হবি কে চড়ে ভাবের নায়?
ভাবের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে ভবের পারে যায় রে
ভাবুক ভবের পারে যায়।
ভবের হাটে ভাবের খেলা, ভাবুক কেন ভোল?
ভাবের জমি চাষ দিয়ে ভাই ভবের পটোল তোল রে
ভাই ভবের পটোল তোল।
শান বাঁধানো মনের ভিটেয় ভাবের ঘুঘু চরে—
ভাবের মাথায় টোক্কা দিলে বাক্য-মানিক ঝরে রে মন
বাক্য-মাণিক ঝরে।
ভাবের ভারে হদ্দ কাবু ভাবুক বলে তায়
ভাব-তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ভাবের খাবি খায় রে
ভাবুক ভাবের খাবি খায়।

[ কীর্তন 'জমাট' হওয়ায় ভাবুকদাদার নিদ্রাচ্যুতি ]

ভাবুক দাদা। জুতিয়ে সব সিধে করব, বলে রাখছি পষ্ট—
চ্যাঁচামেচি করে ব্যাটা ঘুমটি কল্‌লি নষ্ট?

প্রথম ভাবুক। ঘুম কি হে? সিকি কথা? আবাক কল্‌লে খুব!
ঘুমোওনি তো— ভাবের স্রোতে মেরেছিলে ডুব।
ঘুমোয় যত ইতর লোকে— তেলী মুদী চাষা—
তুমি আমি ভাবুক মানুষ ভাবের রাজ্যে বাসা।

ভাবুক দাদা। সে ঘুম নয়, সে ঘুম নয়, ভাবের ঝোঁকে টং
ভাবের কাজল চোখে দিয়ে দেখছি ভাবের রঙ;
মহিষ যেমন পড়ে রে ভাই শুকনো নদীর পাঁকে,
ভাবের পাঁকে নাকটি দিয়ে ভাবুক পড়ে থাকে।

প্রথম ভাবুক। তাই তো বটে, মনের নাকে ভাবের তৈল গুঁজি
ভাবের ঘোরে ভোঁ হয়ে যাই চক্ষু দুটি বুজি!

দ্বিতীয় ভাবুক। হাঃ হাঃ হা— দাদা তোমার বচনগুলো খাসা,
ভাবের চাপে জমাট, আবার হাস্য রসে ঠাসা।

ভাবুক দাদা। ভাবের ঝোঁকে দেখতেছিলেম স্বপ্ন চমৎকার
কোমর বেঁধে ভাবুক জগৎ ভবের পগার পার।
আকাশ জুড়ে তুফান চলে, বাতাস বহে দমকায়,
গাছের পাতা শিহরি কাঁপে, বিজলী ঘন চমকায়
মাভৈ রবে ডাকছি সবে খুঁজছি ভাবের রাস্তা
(এই) ভণ্ডগুলোর গণ্ডগোলে স্বপ্ন হল ভ্যাস্তা।

প্রথম ভাবুক। যা হবার তা হয়ে গেছে— বলে গেছেন আর্য—
গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য।

দ্বিতীয় ভাবুক। কি আশ্চর্য, ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশায়
এমনি করে মহাত্মারা পড়েন ভাবের দশায়!

ভাবুক দাদা। অন্তরে যার মজুত আছে ভাবের খোরাকি—
(তার) ভাবের নাচন মরণ বাঁচন বুঝবি তোরা কি?

দ্বিতীয় ভাবুক। পরাবিদ্যা ভাবের নিদ্রা— আর কি প্রমাণ বাকি
পায়ের ধুলো দাও তো দাদা মাথায় একটু মাখি!

ভাবুক দাদা। সবুর কর স্থিরোভব, রাখ এখন টিপ্পনী,
ভাবের একটা ধাক্কা আসছে, সরে দাঁড়াও এক্ষুনি।

[ ভাবের ধাক্কা ]
প্রথম ভাবুক। বিনিদ্র চক্ষু, মুখে নাহি অন্ন
আক্কেল বুঝি জড়তাপন্ন!
স্নানবিহীন যে চেহারা রুক্ষ—
এত কি চিন্তা— এত কি দুঃখ?

দ্বিতীয় ভাবুক। সঘন বহিছে নিশ্বাস তপ্ত—
মগজে ছুটিছে উদ্দাম রক্ত।
দিন নাই রাত নাই— লিখে লিখে হাত ক্ষয়—
একেবারে পড়ে গেলে ভাবের পাতকোয়!

ভাবুক দাদা। শৃঙ্খল টুটিয়া উন্মাদ চিত্ত
আঁকুপাঁকু ছন্দে করিছে নৃত্য—
নাচে ল্যাগব্যাগ তাণ্ডব তালে
ঝলক জ্যোতি জ্বলিছে ভালে।
জাগ্রত ভাবের শব্দ পিপাসা
শূন্যে শূন্যে খুঁজিছে ভাষা।
সংহত ভাবের ঝংকার মাঝে
বিদ্রোহ ডম্বরু অনাহত বাজে।

দ্বিতীয় ভাবুক। (হ্যাঁ-হ্যাঁ) ঐ শোনো দুড়দাড় মার-মার শব্দ
দেবাসুর পশুনর ত্রিভুবন স্তব্ধ।

প্রথম ভাবুক। বাজে শিঙা ডম্বরু শাঁখ জগঝম্প,
ঘন মেঘ গর্জন, ঘোর ভূমিকম্প—।

ভাবুক দাদা। কিসের তরে দিশেহারা ভাবের ঢেঁকি পাগল পারা
আপনি নাচে নাচে রে!
ছন্দে ওঠে ছন্দে নামে নিত্যধ্বনি চিত্তধামে
গভীর সুরে বাজে রে।
নাচে ঢেঁকি তালে তালে যুগে-যুগে কালে-কালে
বিশ্ব নাচে সাথে রে!
রক্ত-আঁখি নাচে ঢেঁকি, চিত্ত নাচে দেখাদেখি
নৃত্য মাতে মাতে রে!

প্রথম ভাবুক। চিন্তা পরাহতা বুদ্ধি বিশুষ্কা
মগজে পড়েছে ভীষণ ফোসকা!
সরিষার ফুল যেন দেখি দুই চক্ষে!
ডুবজলে হাবুডুবু কর দাদা রক্ষে!

দ্বিতীয় ভাবুক। সূক্ষ্ম নিগূঢ় নব ঢেঁকিতত্ত্ব,
ভাবিয়া-ভাবিয়া নাহি পাই অর্থ!

ভাবুক দাদা। অর্থ! অর্থ তো অনর্থের গোড়া!
ভাবুকের ভাত-মারা সুখ-মোক্ষ-চোরা;
যত সব তালকানা অঘামারা আনাড়ে
'অর্থ-অর্থ' করি খুঁজে মরে ভাগাড়ে!
(আরে) অর্থের শেষ কোথা কোথা তার জন্ম
অভিধান ঘাঁটা, সে কি ভাবুকের কম্ম?
অভিধান, ব্যাকরণ, আর ঐ পঞ্জিকা—
ষোল আনা বুজরুকী আগাগোড়া গঞ্জিকা।
মাখন-তোলা দুগ্ধ, আর লবণহীন খাদ্য,
(আর) ভাবশূন্য গবেষণা— একি ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ?
[ ভাবের নামতা ]
ভাবের পিঠে রস তার উপরে শূন্যি—
ভাবের নামতা পড় মাণিক বাড়বে কত পুন্যি—
(ওরে মানিক মানিক রে নামতা পড় খানিক রে)
ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগুণে ধোঁয়া,
তিন ভাবে ডিসপেপ্‌শিয়া— ঢেকুর উঠবে চোঁয়া
(ওরে মানিক মানিক রে চুপটি কর খানিক রে)
চার ভাবে চতুর্ভুজ ভাবের গাছে চড়—
পাঁচ ভাবে পঞ্চত্ব পাও গাছের থেকে পড়।
(ওরে মানিক মানিক রে এবার গাছে চড় খানিক রে)



Read more ...

ভালো ছেলের নালিশ-সুকুমার রায়।

ভালো ছেলের নালিশ
সুকুমার রায়


ভাল ছেলের নালিশ
মাগো!
প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা
          গুড় মাখিয়ে আরাম ক'রে বসে -
আমায় দেখে একটা দিল ,নয়কো তাও বড়টা,
          দুইখানা সেই আপনি খেল ক'ষে!
তাইতে আমি কান ধরে তার একটুখানি পেঁচিয়ে
          কিল মেরেছি 'হ্যাংলা ছেলে' বলে-
অম্‌‌নি কিনা মিথ্যা করে ষাঁড়ের মত চেচিয়ে
          গেল সে তার মায়ের কাছে চলে!

মাগো!
এম্‌‌নিধারা শয়তানি তার, খেলতে গেলাম দুপুরে,
          বল্‌ল, 'এখন খেলতে আমার মানা'-
ঘন্টাখানেক পরেই দেখি দিব্যি ছাতের উপরে
          ওড়াচ্ছে তার সবুজ ঘুড়ি খানা।
তাইতে আমি দৌড়ে গিয়ে ঢিল মেরে আর খুঁচিয়ে
          ঘুড়ির পেটে দিলাম করে ফুটো-
আবার দেখ বুক ফুলিয়ে সটান মাথা উঁচিয়ে
          আনছে কিনে নতুন ঘুড়ি দুটো!

Read more ...

ভোলানাথের সর্দারি-সুকুমার রায়।

ভোলানাথের সর্দারি
সুকুমার রায়




সকল বিষয়েই সর্দারি করিতে যাওয়া ভোলানাথের ভারি একটা বদ অভ্যাস। যেখানে তাহার কিছু বলিবার দরকার নাই, সেখানে সে বিজ্ঞের মতো উপদেশ দিতে যায়, যে কাজের সে কিছুমাত্র বোঝে না, সে কাজেও সে চট্‌‌পট্‌‌ হাত লাগাইতে ছাড়ে না। এইজন্য গুরুজনেরা তাহাকে বলেন 'জ্যাঠা'- আর সমবয়সীরা বলে 'ফড়ফড়ি রাম' ! কিন্তু তাহাতে তাহার কোনো দুঃখ নাই, বিশেষ লজ্জাও নাই। সেদিন তাহার তিন ক্লাশ উপরের বড় বড় ছেলেরা যখন নিজেদের পড়াশুনা ল‌‌ইয়া আলোচনা করিতেছিল, তখন ভোলানাথ মুরুব্বির মতো গম্ভীর হ‌‌ইয়া বলিল, "ওয়েব্‌‌স্টারের ডিক্‌‌সনারি সব চাইতে ভালো। আমার বড়দা যে দু'ভলুম ওয়েব্‌‌স্টারের ডিক্‌‌সনারি কিনেছেন্, তার এক-একখানা ব‌‌ই এত্তোখানি বড় আর এম্নি মোটা আর লাল চামড়া দিয়ে বাঁধানো"। উঁচু ক্লাশের একজন ছাত্র আচ্ছা করিয়া তাহার কান মলিয়া বলিল, "কি রকম লাল হে? তোমার এই কানের মতো?" তবু ভোলানাথ এমন বেহায়া, সে তার পরদিন‌‌ই সেই তাহাদের কাছে ফুটবল সম্বন্ধে কি যেন মতামত দিতে গিয়া এক চড় খাই‌‌য়া আসিল।

বিশুদের একটা ইঁদুর ধরিবার কল ছিল। ভোলানাথ হঠাৎ‌ একদিন্‌‌ , "এটা কিসের কল ভাই?" বলিয়া সেটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া কলকব্জা এমন বিগড়াইয়া দিল যে, কলটা একেবারেই নষ্ট হ‌‌ইয়া গেল। বিশু বলিল, "না, জেনে শুনে কেন টানাটানি করতে গেলি?" ভোলানাথ কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হ‌‌ইয়া বলিল, "আমার দোষ হল বুঝি? দেখ্‌‌ তো হাতলটা কিরকম বিচ্ছিরি বানিয়েছে। ওটা আরও অনেক মজবুত করা উচিত ছিল। কলওয়ালা ভয়ানক ঠকিয়েছে।"

ভোলানাথ পড়াশুনায় যে খুব ভালো ছিল তাহা নয়, কিন্তু মাস্টার মহাশয় যখন কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন, তখন সে জানুক আর না জানুক সাত তাড়াতাড়ি সকলের আগে জবাব দিবার জন্য ব্যস্ত হ‌‌ইয়া উঠিত। জবাবটা অনেক সময়েই বোকার মত হ‌‌ইত, শুনিয়া মাস্টার মহাশয় ঠাট্টা করিতেন, ছেলেরা হাসিত; কিন্তু ভোলানাথের উৎ‌সাহ তাহাতে কমিত না।

সেই যেবার ইস্কুলে ব‌‌ই চুরির হাঙ্গামা হয়, সেবারও সে এইরকম সর্দারি করিতে গিয়া খুব জব্দ হয়। হেডমাস্টার মহাশয় ক্রমাগত ব‌‌ই চুরির নালিশে বিরক্ত হ‌‌ইয়া, একদিন প্রত্যেক ক্লাশে গিয়া জিগ্‌‌গেস করিলেন, "কে ব‌‌ই চুরি করছে তোমরা কেউ কিছু জানো?" ভোলানাথের ক্লাশে এই প্রশ্ন করিবামাত্র ভোলানাথ তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, "আজ্ঞে, আমার বোধ হয় হরিদাস চুরি করে।" জবাব শুনিয়া আমরা সবাই অবাক হইয়া গেলাম। হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, "কি করে জানলে যে হরিদাস চুরি করে?" ভোলানাথ অম্লানবদনে বলিল, "তা জানিনে, কিন্তু আমার মনে হয়।" মাষ্টার মহাশয় ধমক দিয়া বলিলেন, "জানো না, তবে অমন কথা বললে কেন? ও রকম মনে করবার তোমার কি কারণ আছে?" ভোলানাথ আবার বলিল, "আমার মনে হচ্ছিল, বোধহয় ও নেয়— তাই তো বললাম। আর তো কিছু আমি বলিনি।" মাষ্টার মহাশয় গম্ভীর হ‌‌ইয়া বলিলেন, "যাও হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাও।" তখন‌‌ই তাহার কান ধরিয়া হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাওয়ানো হ‌‌ইল। কিন্তু তবু কি তাহার চেতনা হয়?

ভোলানাথ সাঁতার জানে না, কিন্তু তবু সে বাহাদুরি করিয়া হরিশের ভাইকে সাঁতার শিখা‌‌ইতে গেল। রামবাবু হঠাৎ‌ ঘাটে আসিয়া পড়েন, তাই রক্ষা। তা না হ‌‌ইলে দুজনকেই সেদিন ঘোষপুকুরে ডুবিয়া মরিতে হ‌‌ইত। কলিকাতায় মামার নিষেধ না শুনিয়া চল্‌‌তি ট্রাম হ‌‌ইতে নামিতে গিয়া ভোলানাথ কাদার উপর আছাড় খাইয়াছিল, তিন মাস পর্যন্ত তাহার আঁচড়ের দাগ তাহার নাকের উপর ছিল। আর বেদেরা শেয়াল ধরিবার জন্য যেবার ফাঁদ পাতিয়া রাখে, সেবার সেই ফাঁদ ঘাঁটিতে গিয়া ভোলানাথ কি রকম আটকা পড়িয়াছিল, সেকথা ভাবলে আজও আমাদের হাসি পায়। কিন্তু সব চাইতে যেবার সে জব্দ হ‌‌ইয়াছিল সেবারের কথা বলি শোনো।

আমাদের ইস্কুলে আসিতে হ‌‌ইলে কলেজবাড়ির পাশ দিয়া আসিতে হয়। সেখানে একটা ঘর আছে, তাহাকে বলে ল্যাবরেটরি। সেই ঘরে নানারকম অদ্ভুত কলকারখানা থকিত। ভোলানাথের সবটাতেই বাড়াবাড়ি, সে একদিন একেবারে কলেজের ভিতর গিয়া দেখিল, একটা কলের চাকা ঘুরা‌‌নো হ‌‌ইতেছে, আর কলের একদিকে চড়াক্‌‌ চড়াক্‌‌ করিয়া বিদ্যুতের মতো ঝিলিক্‌‌ জ্বলিতেছে। দেখিয়া ভোলানাথের ভারি শখ হ‌‌ইল সে একবার কল ঘুরা‌‌ইয়া দেখে ! কিন্তু কলের কাছে যাওয়া মাত্র, কে একজন তাহাকে এমন ধমক দিয়া উঠিল যে, ভয়ে এক দৌড়ে সে ইস্কুলে আসিয়া হাঁপা‌‌ইতে লাগিল। কিন্তু কলটা একবার নাড়িয়া দেখিবার ইচ্ছা তাহার কিছুতেই গেল না। একদিন বিকালে যখন সকলে বাড়ি যাইতেছি তখন ভোলানাথ যে কোন সময়ে কলেজবাড়িতে ঢুকিল, তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই। সে চুপিচুপি কলেজবাড়ির ল্যাবরেটরি বা যন্ত্রখানায় ঢুকিয়া, অনেকক্ষন এদিক ওদিক চাহিয়া দেখে, ঘরে কেউ নাই। তখন‌‌ই ভরসা করিয়া ভিতরে ঢুকিয়া সে কলকব্জা দেখিতে লাগিল। সেই দিনের সেই কলটা আলমারির আড়ালে উঁচু তাকের উপর তোলা রহিয়াছে, সেখানে তাহার হাত যায় না। অনেক কষ্টে সে টেবিলের পিছন হ‌‌ইতে একখানা বড় চৌকি ল‌‌ইয়া আসিল। এদিকে কখন যে কলেজের কর্মচারী চাবি দিয়া ঘরের তালা আঁটিয়া চলিয়া গেল, সেও ভোলানাথকে দেখে নাই, ভোলানাথের‌‌ও সেদিকে চোখ নাই। চৌকির উপর দাঁড়া‌‌ইয়া ভোলানাথ দেখিল কলটার কাছে একটা অদ্ভুত বোতল। সেটা যে বিদ্যুতের বোতল, ভোলানাথ তাহা জানে না। সে বোতলটিকে ধরিয়া সরা‌‌ইয়া রাখিতে গেল। অমনি বোতলের বিদ্যুত তাহার শরীরের ভিতর দিয়া ছুটিয়া গেল, মনে হ‌‌ইল যেন তাহার হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কিসের একটা ধাক্কা লাগিল, সে মাথা ঘুরিয়া চৌকি হ‌‌ইতে পড়িয়া গেল।

বিদ্যুতের ধাক্কা খা‌‌ইয়া ভোলানাথ খানিকক্ষন হতভম্ব হ‌‌ইয়া রহিল। তারপর ব্যস্ত হ‌‌ইয়া পলা‌‌ইতে গিয়া দেখে দরজা বন্ধ! অনেকক্ষন দরজায় ধাক্কা দিয়া, কিল ঘুষি লাথি মারিয়াও দরজা খুলিল না। জানালাগুলি অনেক উঁচুতে আর বাহির হ‌‌ইতে বন্ধ করা- চৌকিতে উঠিয়াও নাগাল পাওয়া গেল না। তাহার কপালে দরদর করিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল। সে ভাবিল প্রাণপণে চীৎ‌কার করা যাক্, যদি কেউ শুনিতে পায়। কিন্তু তাহার গলার স্বর এমন বিকৃত শোনা‌‌ইল, আর মস্ত ঘরটাতে এমন অদ্ভুত প্রতিধ্বনি হ‌‌ইতে লাগিল যে, নিজের আওয়াজে নিজেই সে ভয় পা‌‌ইয়া গেল। ওদিকে প্রায় সন্ধ্যা হ‌‌ইয়া আসিয়াছে। কলেজের বট গাছটির উপর হ‌‌ইতে একটা পেঁচা হঠাৎ‌ 'ভুত-ভুতুম-ভুত' বলিয়া বিকট শব্দে ডাকিয়া উঠিল। সেই শব্দে একেবারে দাঁতে দাঁতে লাগিয়া ভোলানাথ এক চীৎ‌কারেই অজ্ঞান!

কলেজের দারোয়ান তখন আমাদের ইস্কুলের পাঁড়েজি আর দু-চারটি দেশ-ভা‌‌ইয়ের সঙ্গে জুটিয়া মহা উৎ‌সাহে 'হাঁ হাঁ করে কাঁহা গয়ো রাম' বলিয়া ঢোল কর্তাল পিটা‌‌ইতেছিল, তাহারা কোনোরূপ চীৎ‌কার শুনিতে পায় নাই। রাতদুপুর পর্যন্ত তাহাদের কীর্তনের হল্‌‌লা চলিল; সুতরাং জ্ঞান হ‌‌ইবার পর ভোলানাথ যখন দরজায় দুম্‌‌দুম্‌‌ লাথি মারিয়া চেঁচা‌‌ইতেছিল, তখন সে শব্দ গানের ফাঁকে ফাঁকে তাহাদের কানে একটু-আধটু আসিলেও তাহারা গ্রাহ্য করে নাই। পাঁড়েজি একবার খালি বলিয়াছিল, কিসের শব্দ একবার খোঁজ লওয়া যাক, তখন অন্যেরা বাধা দিয়া বলিয়াছিল, "আরে চিল্‌‌ল্যানে দেও।" এমনি করিয়া রাত বারোটার সময় যখন তাহাদের উৎ‌সাহ ঝিমাইয়া আসিল, তখন ভোলানাথের বাড়ির লোকেরা লণ্ঠন হাতে হাজির হ‌‌ইল। তাহারা বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া কোথাও তাহাকে আর খুঁজিতে বাকি রাখে নাই। দারোয়ানদের জিজ্ঞাসা করায় তাহার একবাক্যে বলিল, 'ইস্কুল বাবুদের' কোথাও তাহারা দেখে নাই। এমন সময় সেই দুম্‌‌দুম্‌‌ শব্দ আর চীৎ‌কার আবার শোনা গেল।

তারপর ভোলানাথের সন্ধান পা‌‌ইতে আর বেশি দেরি হ‌‌ইল না। কিন্তু তখনও উদ্ধার নাই- দরজা বন্ধ, চাবি গোপালবাবুর কাছে, গোপালবাবু বাসায় নাই, ভাইজির বিবাহে গিয়াছেন, সোমবার আসিবেন। তখন অগত্যা ম‌‌ই আনা‌‌ইয়া, জানালা খুলিয়া, সার্সির কাঁচ ভাঙিয়া, অনেক হাঙ্গামার পর ভয়ে মৃতপ্রায় ভোলানাথকে বাহির করা হ‌‌ইল। সে ওখানে কি করিতেছিল, কেন আসিয়াছিল, কেমন করিয়া আটকা পড়িল ইত্যাদি করিবার জন্য তাহার বাবা প্রকাণ্ড এক চড় তুলিতেছিলেন, কিন্তু ভোলানাথের ফ্যাকাশে মুখখানা দেখিবার পর সে চড় আর তাহার গালে নামে নাই।

নানাজনে জেরা করিয়া তাহার কাছে যে সমস্ত কথা আদায় করিয়াছেন, তাহা শুনিয়াই আমরা আটকা পড়িবার বর্ণনাটা দিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে এত কথা কবুল করে নাই। আমাদের কাছে সে আরও উল্টা বুঝাইতে চাহিয়াছিল যে, সে ইচ্ছা করিয়াই বাহাদুরির জন্য কলেজবাড়িতে রাত কাটাইবার চেষ্টায় ছিল। যখন সে দেখিল যে, তাহার কথা কেহ বিশ্বাস করে না, বরং আসল কাথাটা ক্রমে ফাঁস হ‌‌ইয়া পড়িতেছে, তখন সে এমন মুষড়াইয়া গেল যে, অন্তত মাস তিনেকের জন্য তাহার সর্দারির অভ্যাসটা বেশ একটু দমিয়া পড়িয়াছিল।

Read more ...

ভয় পেয়োনা-সুকুমার।

ভয় পোয়োনা
সুকুমার রায়



ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না
সত্যি বলছি কুস্তি ক'রে তোমার সঙ্গে পারব না।
মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না---
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?
এস এস গর্তে এস, বাস ক'রে যাও চারটি দিন,
আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?
মুগুর আমার হাল্‌কা এমন মারলে তোমার লাগবে না।
অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!
আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে
সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

Read more ...

ভূল গল্প-সুকুমার রায়।

ভূল গল্প
সুকুমার রায়



[ এই গল্পের মধ্যে ইচ্ছা করিয়া কতগুলি ভুল বর্ণনা করা হইয়াছে। কোথাও হয়ত এমন কথাও লেখা হইয়াছে যাহা একেবারেই অসম্ভব; অথবা এক জায়গায় যাহা লেখা হইয়াছে অন্য জায়গায় তাহারই উল্টা কথা বলা হইয়াছে— একটা ঠিক হইলে আর একটা ঠিক হইতেই পারে না। দেখ তো এই রকম ভুল কতগুলি বাহির করিতে পার। ]

রামবাবু লোকটি যেমন কৃপণ, তাঁর প্রতিবেশী বৃন্দাবনচন্দ্রের আবার তেমনি হাত খোলা। দুজনের বহুকালের বন্ধুতা, অথচ কি চেহারায়, কি স্বভাব-প্রকৃতিতে কোথাও দুজনের মিল নেই। বৃন্দাবন বেঁটেখাটো গোলগাল গোছের মানুষ, তাঁর মাথা ভরা টাক, গোঁফ-দাড়ি সব কামানো। ছাপ্পান্ন বছর অতি প্রশংসার সঙ্গে রেজেস্ট্রি অফিসে চাকরি করে শেষদিকে তাঁর খুব পদোন্নতি হয়েছিল; এখন ষাট বছর বয়সে তিনি সবে মাত্র পেন্‌সন নিয়ে বিশ্রাম করছেন। তিনি, তার গিন্নি, আর এক বুড়ো জ্যেঠামশাই, এ-ছাড়া ত্রিসংসারে তাঁর আর কেউ নেই। জ্যেঠামশাই বিয়েটিয়ে করেননি, বৃন্দাবনের সঙ্গেই থাকেন। রামপ্রসাদ সান্যাল লোকটি ছিপছিপে লম্বা; পোস্টমাস্টার প্রাণশঙ্কর ঘোষ ছাড়া তেমন ঢ্যাঙা লোক সে পাড়াতে আরে খুঁজে পাবে না। এক অক্ষর ইংরাজি জানেন না, কিন্তু মার্বেল পাথর আর পাটের তেলের ব্যবসা করে তিনি প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি করেছেন, দেশে জমিদারী কিনেছেন আর নানারকম কারখানার অংশীদার হয়ে বসেছেন। তাঁর আটটি ছেলে, কিন্তু মেয়ে একটিও হল না বলে তাঁর ভারি দুঃখ। প্রকাণ্ড কপাল, তার উপর একরাশ চুল, মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি আর চোখে হাল-ফ্যাশানের ফ্রেম-ছাড়া চশমা, কানের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, কেবল নাকের উপর স্প্রিং দিয়ে এঁটে বসানো। মোট কথা, দেখলেই বোঝা যায় যে মানুষটি কম কেউকেটা নন।

প্রতিদিন সন্ধ্যা হতেই পাড়ার মাতব্বর বাবুরা সবাই রামবাবুর বৈঠকখানা ঘরে এসে জোটেন, আর পান-তামাক-চা-বিস্কুট-সন্দেশ ইত্যাদির সঙ্গে খুব হাসি-তামাশা গল্প-গুজব চলতে থাকে। বৈঠকখানা ঘরটি বেশ বড়, মেঝের উপর প্রকাণ্ড ফরাশ পাতা, তার উপর কতকগুলো মোটাসোটা তাকিয়া আর রঙচঙে হাত-পাখা এদিক ওদিক ছড়ানো। তাছাড়া ঘরের মধ্যে কোথাও চেয়ার-টেবিল বা কোনোরকম আসবাবপত্র একেবারেই নেই। পোস্টমাস্টার বাবু, হরিহর ডাক্তার, যতীশ রায়, হেডমাস্টার, ইনস্পেকটার বাড়ুয্যে প্রভৃতি অনেকেই সেখানে প্রায় প্রতিদিন আসেন। বৃন্দাবন বসু বড়ো লাজুক লোক, প্রথম প্রথম সেদিকে বড় একটা ঘেঁষতেন না। সে-পাড়ায় তিনি সবে নতূন এসেছেন, কারও সঙ্গে আলাপ পরিচয় নেই, খালি পোস্টমাস্টারবাবুর সঙ্গে একটু জানাশোনা। যা হোক, পোস্টমাস্টারবাবু নাছোড়বান্দা লোক, তিনি বড়দিনের ছুটির মধ্যে এক রবিবার একরকম জোর করেই তাঁকে রামবাবুর বাড়ি নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন। প্রথমদিনের পরিচয়েই দুজনার আলাপ এমন জমে উঠল যে তারপর থেকে রামবাবুর বৈঠকে যাবার জন্য বৃন্দাবনচন্দ্রকে আর কোনো তাগিদ দেওয়ার দরকার হত না।

এই ঘটনার সাতদিন পরে একদিন রামবাবুর বৈঠক খুব জমেছে। মানুষকে চিনতে না পারার দরুন কত সময়ে কত অদ্ভুত ভুল হয়, তাই নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। হরিহরবাবু বললেন, "আমি একবার যা ফ্যাসাদে পরেছিলাম, সে বোধহয় আপনাদের বলিনি। সে প্রায় বিশ বছরের কথা। একদিন সন্ধ্যার সময় খাওয়া দাওয়া সেরে একটু শিগ্‌গির শিগ্‌গির ঘুমব ভাবছি, এমন সময়ে আমার ডিসপেনসারির চাকরটা এসে খবর দিল, প্রমথবাবু এসেছেন। প্রমথ মিত্তির তখন তার মাথার ব্যারামের জন্য আমাকে দিয়ে চিকিৎসা করাত। সেদিন কথা ছিল, আমি তার জন্য একটা মিকস্‌চার তৈরি করিয়ে রাখব, সে সন্ধ্যার সময় সেটা নিয়ে যাবে। তাই চাকর এসে খবর দিতেই আমি ওষুধের শিশিটা তার হাতে দিয়ে সেই সঙ্গে একটা কাগজে লিখে দিলাম, 'ওষুধটা এখুনি এক দাগ খাবেন। দুর্বল মস্তিষ্কের পক্ষে কোনোরকম মানসিক পরিশ্রম বা উত্তেজনা ভালো নয়, এ-কথা সর্বদা মনে রাখবেন। তাহলেই আপনার মাথার ব্যারাম শিগ্‌গির সারবে।' মিনিট খানেক যেতে না যেতেই চাকরটা ঘুরে এসে খবর দিল যে বাবুটি বেজায় খাপ্পা হয়েছেন এবং দাওয়াইয়ের শিশিটি ভেঙে আমায় গাল দিতে দিতে প্রস্থান করেছেন। শুনে তো আমার চক্ষুস্থির! যা হোক, ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে বেশি দেরি হল না। একটু সন্ধান করতেই বোঝা গেল যে, লোকটি মোটেই প্রমথ মিত্তির নন, আমারই মামাশ্বশুর, বাঁশবেড়ের প্রমথ নন্দী। যেরকম বদমেজাজী লোক, সে রাত্রেই আমায় ছুটতে হল বুড়োর তোয়াজ করবার জন্য। বুড়ো কি সহজে ঠাণ্ডা হয়! তাঁকে অপমান করা, বা তাঁর সঙ্গে ইয়ার্কি করা যে আমার মোটেই অভিপ্রায় ছিল না এবং ওষুধটা কিম্বা চিঠিটা যে তাঁর জন্য দেওয়া হয়নি, এই সহজ কথাটি তাঁর মাথায় ঢোকাতে প্রায় দুটি ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এদিকে বাসায় ফিরে শুনি প্রমথ মিত্তির এসে তার ওষুধ তৈরি না পেয়ে খুব বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। পরদিন সকালে আবার তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করি।"

এই গল্পটা শুনে ইনস্পেকটারবাবু বললেন, "আপনার তো, মশাই, অল্পের উপর দিয়ে গেল, আমার ঐ রকম একটা ভুলের দরুন চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়েছিল। সেও বহু দিনের কথা, তখন আমি সবেমাত্র পুলিসের চাকরি নিয়েছি। ঘোষপুরের বাজার নিয়ে সে সময়ে সুদাস মণ্ডলের সঙ্গে রায়বাবুদের খুব ঝগড়া চলছে। একদিন বিকেলে খবর পাওয়া গেল, আজ সন্ধ্যার পর সুদাস লাঠিয়াল নিয়ে বাজার দখল করতে আসবে। ইনস্পেকটার যোগীনবাবুর হুকুমে আমি ছয়জন কনস্টেবল নিয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি ঘোষপুরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না; সন্ধ্যার একটু পরেই দেখলাম নদীর দিক থেকে কিসের আলো আসছে। মনে হচ্ছে কারা যেন কাঁঠালতলায় বসে বিশ্রাম করছে। ব্যাপার কি দেখবার জন্য আমি খুব সাবধানে একটা ঝোপের আড়াল পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি একটা মশালের ঝাপসা আলোয় লাঠি হাতে কয়েকটা লোক বসে আছে, আর এক পালকির আড়ালে দুজন লোক কথাবার্তা বলছে। কান পেতে শুনলাম একজন বলল, 'সুদাসদা, কতদূর এলাম?' উত্তর হল, 'এই তো ঘোষপুরের বাজার দেখা যাচ্ছে।' অম্নি আর কথা নেই। আমি জোরে শিস্‌ দিতেই সঙ্গের পুলিশগুলো মার-মার করে তেড়ে এসেছে। পুলিশের সাড়া পাবামাত্র সুদাসের লোকগুলো 'বাপরে মারে' করে কে যে কোথায় সরে পড়ল তা আর ধরতেই পারা গেলা না। কিন্তু পালকির কাছে যে দুটো লোক ছিল, তারা খুব সহজেই ধরা পড়ে গেল। তাদের একজনের বয়েস অল্প, চেহারা গোঁয়ারগোবিন্দ গোছের— বুঝলাম এই সুদাস মণ্ডল। সে আমায় তেড়ে কি যেন বলতে উঠেছিল, আমি এক ধমক লাগিয়ে বললাম, 'হাতে হাতে ধরা পড়েছ বাপু, এখন রোখ করে কোনো লাভ নেই, কিছু বলবার থাকে তো থানায় গিয়ে ব'লো।' শুনে তার সঙ্গের বুড়ো লোকটা ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে খানিকক্ষণ অনর্গল কি যে বকে গেল আমি তার কিছুই বুঝলাম না, খালি বুঝলাম যে সে আমাদের তার 'সুদাসদা'র পরিচয় বোঝাচ্ছে। আমি বললাম, 'অত পরিচয় শুনবার আমার দরকার নেই, আসল পরিচয়টা আজ ভালোরকমই পেয়েছি।' তারপর তাদের হাতকড়া পরিয়ে মহা ফুর্তিতে তো থানায় এনে হাজির করা গেল। তারপর মশাই যা কাণ্ড! হেড ইনস্পেকটার যতীনবাবু রাগে আগুনের মতো লাল হয়ে, টেবিল থাবড়িয়ে, দোয়াত উলটিয়ে, কাগজ কলম ছুঁড়ে আমায় খুব সহজেই বুঝিয়ে দিলেন যে আমি একটি আস্ত রকমের হস্তীমূর্খ ও অর্বাচীন পাঁঠা। যে লোকটিকে ধরে এনেছি সে মোটেই সুদাস মণ্ডল নয়, তার নাম সুবাসচন্দ্র বোস; সে যতীনবাবুরই জামাই, সঙ্গের লোকটি তার ঠাকুরদার আমলের চাকর; যতীনবাবুর কাছেই তারা আসছিল। আমার বুদ্ধিটা হাঁ-করা বোয়াল মাছের মতো না হলে, আমি সুবাস শুনতে কখনই সুদাস শুনতাম না— ইত্যাদি। অনেক কষ্টে অনেক খোশামুদি করে, অনেক হাতে পায়ে ধরে, সে যাত্রায় চাকরিটা বজায় রাখতে হয়েছিল।"

ইনস্পেকটারের গল্প শেষ হতেই বৃন্দাবনবাবু টিকি দুলিয়ে বললেন, "আপনাদের গল্প শুনে আমারও একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সেও ঐরকম 'উদোর-বোঝা-বুদোর-ঘাড়ে' গোছের গল্প। তবে ভুলটা আমি নিজে করিনি, করেছিল আমার ভাইপো— সেই যে ছোকরাটি এখন মেডিকেল কলেজে পড়ে। একদিন সন্ধ্যার সময় ঘরের মধ্যে বসে আছি। ঘরেও বাতি জ্বালা হয়নি, বাইরেও বেশ অন্ধকার, খালি সরু নখের মতো একটুখানি চাঁদ সবেমাত্র পুবদিকে উঁকি দিয়েছে; এমন সময় মনে হল যেন একটা মানুষ দেয়াল বেয়ে বেয়ে ছাদের উপর উঠছে—"

বৃন্দাবনবাবু সবে এইটুকু বলেছেন, এমন সময় বারান্দায় কে ডাক দিল, "বাবু, টেলিগ্রাম।" রামবাবু তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে টেলিগ্রামখানা নিয়ে আসলেন, তারপর চোখের চশমাটি কপালে তুলে টেলিগ্রামখানা খুলে পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে তাঁর চোখ ক্রমেই গোল হয়ে উঠছে দেখে ডাক্তারবাবু জিগগেস করলেন, "কি ব্যাপারখানা কি?" রামবাবু ধপাস্‌ করে সোফার উপর বসে পড়ে বললেন, "এই দেখুন না, দেশ থেকে পরেশ টেলিগ্রাম করছে— সিরিয়াস এক্‌সিডেন্ট কাম্‌ হোম ইমেডিয়েটলি।" (অর্থাৎ গুরুতর দুর্ঘটনা, শীঘ্র বাড়ি আসুন)। রামবাবুর তিন ছেলে কয়দিন হল পুজোর ছুটিতে দেশে গিয়েছে, আর একটি মামাবাড়িতে আছে, আর বাকি তিনটে মায়ের কাছে বাড়িতেই রয়েছে। রামবাবু বললেন, "এত লোক থাকতে পরেশ ছোকরাটাকে দিয়েই বা টেলিগ্রাম করাতে গেল কেন? দুটো পয়সা খরচ করে বড়রা কেউ একটু ভালো করে গুছিয়ে টেলিগ্রাম করলেই পারত। এখন কি যে করি? আজ বিষ্যুৎবার, এ-সময়ে রওয়ানাই বা হই কেমন করে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।" তিনি চাকরকে ডেকে তিনতলার বড় ঘর থেকে তাঁর কলমটা আনতে বললেন, আর বললেন, "একটা টেলিগ্রাম করে দেখা যাক কি জবাব আসে।" এই ব'লে তিনি আবার টেলিগ্রামখানা পড়তে লাগলেন।

গল্পগুজব তো চুলোয় গেল, সবাই মিলে ভাবতে বসল এখন কি করা যায়। এমন সময় রামবাবু হঠাৎ বলে উঠেলেন, "ও কি! এ কার টেলিগ্রাম? এ তো দেখছি 'রমাপদ সেন' লেখা। আমার কি যে চোখ হয়েছে, আমি পড়ছি রমাপ্রসাদ সান্যাল।" বলতেই পোস্টমাস্টার প্রিয়শঙ্কর বলে উঠলেন, "ও! রমাপদ যে ও-পাড়ার গুপীবাবুর ভাই, আমি জানি তার শ্বশুরের নাম পরেশনাথ কি যেন।" তখন একটা হাসির ধুম পড়ে গেল।

রামবাবু বললেন, "দেখলেন মশাই, পিয়ন ব্যাটার কাণ্ড! এক ভুল টেলিগ্রাম দিয়ে আমার মেরেছিল আর কি! একে বুড়ো বয়েস, তাতে আবার জানেন তো আমার হার্টের ব্যারাম আছে।" হেডমাস্টার যতীশবাবু শুনে হেসে বললেন, "আপনি আবার এর মধ্যেই হলেন কি করে?" রামবাবু বললেন, "বিলক্ষণ! এ পাড়ায় আমার মতন বুড়ো আর ক'টি খুঁজে পান বলুন তো! এই আষাঢ় মাসে আমি ষাটের কোঠায় পা দিয়েছি।" বৃন্দাবনবাবু বললেন, " তাহলে আমার জ্যেঠামশায়ের কাছে আপনার হার মানতে হল। তাঁর বয়েস উনসত্তর।" ডাক্তারবাবু বললেন, "আমারও বড় কম হয়নি, চৌষট্টি পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ-পাড়ায় বয়েসের জন্য যদি প্রাইজ দিতে হয়, তাহলে ভোলানাথের বাপকেই দেওয়া উচিৎ; তার নাকি এখ আটাত্তর বছর চলেছে।" এই রকম বাজে কথা চলছে, এমন সময়ে বড় বড় বারকোশের উপর থালা সাজিয়ে রামবাবুর তিনটে চাকর খাবার নিয়ে হাজির। কচুরি, নিমকি, সন্দেশ থেকে পিঠে পায়েস পর্যন্ত প্রায় বারো-চোদ্দ রকমের খাবার। ডাক্তার বললেন, "বাপরে! এ যে বিরাট আয়োজন। ব্যাপারখানা কি?" রামবাবু বললেন, "ঐ যা! আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি। আজ আমার জামাই এসেছেন, তাই বাড়িতে একটু মিষ্টি মুখের আয়োজন করা হয়েছে।" ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, "এত বড় গুরুতর কথাটাই বলতে ভুলে গেলেন? আপনার বয়েসটা নিতান্তই বেড়ে গেছে দেখছি।" বৃন্দাবনবাবু বললেন, "তা হোক, আজকের বৈঠকে অনেক রকমই ভুলের কাণ্ড শুনলাম আর দেখলাম, কিন্তু এ ভুলটি বেশিদূর গড়ায়নি। আসুন, এখন ভুলটা সংশোধন করে নেওয়া যাক।"

ভুলের তালিকা
(১) গোড়াতেই রামবাবুকে কৃপণ বলা হইয়াছে, কিন্তু গল্পে তাঁহার স্বভাবের যে পরিচয় দেওয়া হইয়াছে তাহা মোটেই কৃপণের মতো নয়।
(২) বলা হইয়াছে রামবাবু ও বৃন্দাবনবাবুর মধ্যে বহুকালের বন্ধুতা অথচ পরেই বলা হইয়াছে কারো সঙ্গেই বৃন্দাবনবাবুর আলাপ পরিচয় নাই।
(৩) প্রথমেই বৃন্দাবনবাবুর মাথা-ভরা টাক বলা হইয়াছে, অথচ তিনি টিকি দুলাইতেছেন।
(৪) প্রথমে বলা হইয়াছে তাঁহার বয়স ৬০, কিন্তু তিনি চাকরি করিয়াছেন ৫৬ বৎসর।
(৫) বলা হইয়াছে যে গিন্নী আর জ্যেঠামহাশয় ছাড়া তাঁহার আর কেহ নাই, কিন্তু পরে তাঁহার এক ভাইপোকে হাজির করা হইয়াছে।
(৬) প্রথমে পোস্টমাস্টারের নাম বলা হইয়াছে প্রাণশঙ্কর, পরে লেখা হইয়াছে প্রিয়শঙ্কর।
(৭) রামবাবু ইংরাজী জানেন না, অথচ তিনি চট্‌পট্‌ ইংরাজী টেলিগ্রাম পড়িতেছেন।
(৮) রামবাবু পাটের তেলের ব্যবসা করেন কিন্তু এরকম কোনো তেল বা ব্যবসার কথা শোনা যায় না।
(৯) তাঁহার বাড়ি দোতলা বলা হইয়াছে কিন্তু চাকরকে তিনতলায় পাঠানো হয়েছে।
(১০) রামবাবুর আটটি ছেলে কিন্তু মাত্র সাতটির খবর পাওয়া যাইতেছে।
(১১) রামবাবুর মেয়ে নাই কিন্তু তাঁহার জামাই আসিয়া হাজির।
(১২) তাঁহার চশমার যে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে সেরূপ চশমা কপালে তোলা যায় না।
(১৩) প্রথমে বলা হইয়াছে ঘরে কোনোরকম আসবাবপত্র নাই কিন্তু পরে সোফার উল্লেখ করা হইয়াছে।
(১৪) বলা হইয়াছে, 'বড়দিনের ছুটির মধ্যে এক রবিবার' বৃন্দাবন রামবাবুর সঙ্গে দেখা করিলেন; গল্পের ঘটনা তাহার 'সাত দিনের পরে' সুতরাং বৃহস্পতিবার হইতেই পারে না।
(১৫) বড়দিনের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পূজার ছুটি অসম্ভব।
(১৬) বৃন্দাবনবাবুর বয়েস গোড়াতেই ৬০ বলা হইয়াছে। তাহা হইলে তাঁর জ্যেঠামহাশয়ের বয়েস মোটে ৬৯ হইতেই পারে না।
(১৭) চাঁদকে যখন আমরা সূর্যের কাছাকাছি দেখি তখনই তাহার চেহারা থাকে 'সরু নখের মতো।' সন্ধ্যার সময় পুবদিকে, অর্থাৎ সূর্যের উল্‌টা দিকে তাহার ওরকম চেহারা অসম্ভব।

Read more ...

ভূতুরে খেলা-সুকুমার রায়।

ভূতুরে খেলা
সুকুমার রায়

পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছ্‌নাতে।
কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত-পা নেড়ে উল্লাসে,
আহ্লাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে।
শুনতে পেলাম ভুতের মায়ের মুচকি হাসি কট্‌কটে-
দেখছে নেড়ে ঝুন্‌‌টি ধ'রে বাচ্চা কেমন চট্‌পটে।
উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে,
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে!
যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা,
আদর ক'রে আছাড় মেরে শূন্যে ঝোলে চ্যাং দোলা।
বলছে আবার, ``আয় রে আমার নোংরামুখো সুঁটকো রে,
দেখ না ফিরে প্যাখ্‌না ধরে হুতোম-হাসি মুখ করে!
ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁত্কা রে,
অন্ধবনের গন্ধ-গোকুল, ওরে আমার হোঁত্কা রে!
ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্ঠি মাসের বিষ্টি রে,
ওরে আমার হামান-ছেঁড়া জষ্ঠিমধুর মিষ্টি রে।
ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
ওরে আমার জোছ্‌না হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার।
ওরে আমার গোবরাগণেশ ময়দাঠাসা নাদুস্ রে,
ছিঁচকাঁদুনে ফোক্‌লা মানিক, ফের যদি তুই কাঁদিস রে-''
এই না বলে যেই মেরেছে কাদার চাপটি ফট্ ক'রে,
কোথায়-বা কি, ভুতের ফাঁকি- মিলিয়ে গেল চট্ ক'রে!

Read more ...

যুদ্ধের আলো-সুকুমার রায়।

যুদ্ধের আলো
সুকুমার রায়

সেকালে অর্থাৎ পুরাণে যে কালের কথা বলা হয় সেই কালে লড়াইটা হত দিনের বেলায়। ভীষ্মপর্বে দশ দিন ধরে লড়াই হল; প্রতিদিনই দেখি সন্ধ্যা না হতেই শঙ্খধ্বনি করে যুদ্ধ থেমে গেল, তারপর যে যার মতো শিবিরে ফিরে গেল। এইরকম দিনের বেলা লড়াই করে রাত্রে সবাই নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করত। কিন্তু আজকালকার যুদ্ধে এরকম হবার যো নেই। এখন কি দিন কি রাত, কোন সময়েই নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভব নয়। শত্রু যে কখন কোন সুযোগে ঘাড়ে এসে পড়বে, তার জন্য সর্বদা জেগে থাকতে হয়। সৈন্যেরা যুদ্ধ থামিয়ে সবাই মিলে অস্ত্রশস্ত্র গুটিয়ে শিবিরে ফিরে গেল, এরকমটি কোন সময়েই হতে পারে না। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময়েই সৈন্য হাজির রাখতে হয়।

কামানেরও বিশ্রাম নেই। রাত্রের অন্ধকারে ঝড়ে বাদলে যখন তখন সে হুঙ্কার দিয়ে উঠছে। তার চোখে দেখবার দরকার হয় না, কেবল ম্যাপ দেখে অঙ্ক কষে হিসাব করে সে গোলা ছুঁড়ছে; দিনে রাতে কোন সময়েই শত্রুকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যরা খাদ কেটে তারই মধ্যে হয়ত খোলা ময়দানে কত রাত কাটাচ্ছে। সেখানে সারারাত ধরে কড়া পাহারা বসান আছে—কোনখানে টুঁ শব্দটি হলেই তারা কান খাড়া করে শোনে। কোথাও কোন ভয়ের কারণ দেখলেই ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেয়—আর আকাশে তারাবাজি ছুটিয়ে চারদিক আলো করে দেখে , শত্রু আসছে কি না!

যেমন ডাঙায় তেমনি জলে—আবার আকাশেও তেমনি। কোথাও দিনের অপেক্ষায় কেউ বসে থাকে না। কত যুদ্ধের জাহাজ সারারাত সমুদ্রের মধ্যে হাঁ হাঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার 'Search light'-এর ঝকঝকে আলো খড়গের মতো অন্ধকার কেটে চারিদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই আলো যেখানে পড়ে সেখানে যেন একেবারে রাতকে দিন করে ফেলে। সেই আলোর মুখে যদি কোন শত্রুজাহাজ পড়ে তবে তার আর লুকোবার যো নেই। সে যেদিকে যাবে, আলো তার পিছন পিছন ঘুরবে। আর সেই আলোতে পরখ করে যুদ্ধজাহাজ তার উপর কামান দাগবে। তখন তার প্রাণভয়ে পালান ছাড়া আর উপায় নেই। অন্ধকার রাত্রে জার্মানদের বোমাওয়ালা 'জেপেলিন' বেলুনগুলো যখন আকাশ বেয়ে চোরের মতো আসতে থাকে তখন তার সাড়া পেলেই অমনি বড় বড় আলোর ঝাপটা চারিদিকে ছুটে বেরোয়—আকাশ হাতড়ে খুঁজবার জন্য। যুদ্ধে সময় আলোর ব্যবহারটা যতই ভয়ানক হোক না কেন, তামাসা হিসাবে আলোটা দেখতে ভারি সুন্দর। বড় বড় দরবারী ব্যাপারের সময় দশ বিশটা জাহাজ একসঙ্গে মিলে যখন আলোর খেলা দেখাতে থাকে তখন সে এক চমৎকার দৃশ্য হয়।

কিন্তু জাঁকাল ব্যাপারের কথা যদি বল তবে রাত্রে ডাঙায় লড়াইয়ের সময় যে আলোর খেলা চলে, তার আর তুলনা হয় না। চারিদিকে হাজার হাজার কামান আর বন্দুক, তাদের মুখে মুখে লাল আগুন ঝিক্‌মিক্‌ করে উঠছে। থেকে থেকে রং বেরঙের তারাবাজি ছুঁড়ে নানারকম সংকেত চলছে। মনে কর, জার্মান খাদের উপর তারা ফুটছে—সাদা লাল, সাদা লাল—তার মানে 'শত্রু সৈন্য এদিকে আসছে—কামান চালাও।' খানিক পরে হয়ত দেখবে, লাল সবুজ লাল সবুজ লাল সবুজ—জার্মানরা বলছে, 'আমরা কোণঠাসা হয়েছি—শীঘ্র উদ্ধার কর।' মাঝে মাঝে এক একটা বড় বড় 'ফানুষ তারা' আস্তে আস্তে জ্বলতে জ্বলতে চারিদিক আলো করে মাটিতে পড়ছে—সেই আলোতে লড়াই আবার জমে উঠেছে। হয়ত আশেপাশে ভাঙাচোরা গ্রামগুলোতে আগুন ধরে এক একদিকে আকাশের গায়ে লাল হয়ে উঠছে। তার উপর, থেকে থেকে শত্রুদের চোখ ধাঁধিয়ে বিদ্যুতের আলোর মতো 'সার্চ লাইট' এসে পড়েছে। উপরে নীচে চারিদিকে বড় বড় গোলা ফাটছে—এক মুহূর্ত আলোর ঝিলিক্‌, তারপর পাহাড় প্রমাণ ধোঁয়া। আলোয় আঁধারে ছায়ায় ধোঁয়ায় মিলে কি ভীষণ তামাসা!

Read more ...